
ভয়াবহতার মূলে এডিস মশার অস্বাভাবিক প্রজনন
- আপলোড সময় : ৩১-০৭-২০২৫ ১০:১২:৪২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩১-০৭-২০২৫ ১০:১২:৪২ পূর্বাহ্ন


মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও এডিস বাহিত রোগের বিস্তার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে বাসা-বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। একই অবস্থা এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের চিত্রেও। যেখানে ২০২৪ সালে এ হার ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ, সেটি ২০২৫ সালে পাওয়া গেছে ৭৫ শতাংশের বেশি। যা তুলনা করলে এডিস মশার ঘনত্ব দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণও ছড়াচ্ছে ভয়াবহ গতিতে। উদ্বেগ আছে জিকা ভাইরাস নিয়েও। যা নিয়ে ইতোমধ্যে ঝুঁকির কথা স্পষ্ট করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব বিভাগ আইইডিসিআর। এদিকে, স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছয়গুণ। আর একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ শতাংশের বেশি। হাসপাতালজুড়ে বাড়ছে রোগীর ভিড়, আক্রান্ত হচ্ছেন একই পরিবারের একাধিক সদস্য। চিকিৎসকদের মতে, এই সংক্রমণের মূলেই রয়েছে এডিস মশা। নগরবাসী বলছেন, মশার উপদ্রব অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এ বছর বেশি। যে হারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সমহারে পদক্ষেপ নেওয়াতো দূরের থাক, দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। নীরবেই বিস্তার ঘটছে এডিস বাহিত ভাইরাসটির। চলতি মাসে সরকারের আইইডিসিআর এর জরিপেও সে উদ্বেগের কথা জানানো হয়। তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের পরিচালিত জরিপে ২০০টি বাড়ির মধ্যে ৭৪টিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। যার হার ছিল ৩৭ শতাংশ। পরের বছর ২০২৫ সালে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নগরীর ছয়টি এলাকায় জরিপ চালিয়ে ১২৮টি বাড়ির মধ্যে ৬২টিতে লার্ভা খুঁজে পায়। যার হার দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আরও উদ্বেগজনক চিত্র উঠে আসে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ (এডিস লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক) বিশ্লেষণে। যা পরিমাপ করে লার্ভার ঘনত্ব। ২০২৫ সালে গড় ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ ছিল ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত ২০ শতাংশ ঝুঁকিসীমার প্রায় চারগুণ বেশি। কিছু এলাকায় এ হার পৌঁছেছে ১৩৪ দশমিক ৬২ শতাংশে। অথচ ২০২৪ সালের জরিপে সর্বোচ্চ ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ ছিল ৮০ শতাংশের নিচে। যা ওই বছর মোট জরিপে ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ। হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসেই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গতকাল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৩৬৬ জন রোগী। গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৯৮ জন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু হলেও, চলতি বছরের জুলাইয়ে মারা গেছেন ছয়জন। এর পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণও। বেসরকারি ল্যাবগুলোর তথ্য বলছে, রোগ শনাক্তের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি রোগীই চিকুনগুনিয়া পজিটিভ। যদিও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যে জানানো হয়েছে- গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৬৪ জন। আক্রান্ত হচ্ছেন একই পরিবারের একাধিক সদস্য। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, আমাদের কাছে যে পরিমাণ জ্বরের রোগী আসছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই চিকুনগুনিয়ার লক্ষণধারী। পরীক্ষার খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে ল্যাবে যাচ্ছেন না। তাই লক্ষণ বিবেচনায়ই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে এখন চিকুনগুনিয়া-ডেঙ্গু রোগীই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যা মশা থেকেই সৃষ্ট রোগ। এদিকে, দুই জরিপেই এডিস মশার লার্ভার উৎস হিসেবে উঠে এসেছে একই চিত্র। প্লাস্টিক ড্রাম, বাস্কেট, টায়ার, মাটির পাত্র, ফুলের টব, ভবনের লিফটের নিচে জমা পানি, খোলা জায়গার জমানো পানিতে মিলেছে মশার প্রজননস্থল। বারবার এসব জায়গা চিহ্নিত হলেও কার্যকর ও নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রমের ঘাটতির কারণে পুরোনো ফাঁদেই নতুন লার্ভা জন্ম নিচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। আইইডিসিআর জরিপের সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি দলও উপস্থিত ছিল। প্রতিষ্ঠানটির মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনবলও বাড়ানো হয়েছে। তবে নগরবাসীর অভিযোগ ভিন্ন। তাদের অভিযোগ, প্রতিবছর প্রাদুর্ভাব বাড়লে কিছুদিন সক্রিয়তা দেখা গেলেও পরে তা স্থবির হয়ে পড়ে। বছরের বাকি সময় মশক নিধন কার্যক্রম থাকে নামমাত্র। ফলে প্রতি বছর বাড়ছে ঝুঁকি। এতে সাধারণ মানুষ মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন আর তাতে বাড়ছে মৃত্যুও। ২০২৪ সালের সুপারিশে বলা হয়েছিল ৫ থেকে ৬ দিন পরপর সুনির্দিষ্ট নিয়মে ওষুধ ছিটানো। বাস্তবে কার্যক্রম খুব কম এলাকা জুড়েই ছিল। যে কারণে ২০২৫ সালের শুরু থেকেই নগরবাসী এর ফল ভোগ করছেন বলেও অভিযোগ বাসিন্দাদের। হালিশহরের বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান বলেন, বছরের বেশির ভাগ সময়েই কোনো দৃশ্যমান মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চোখে পড়ে না। যে কারণে প্রতিবছর বর্ষা এলেই বাড়ে সংক্রমণ ও আতঙ্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিহ্নিত উৎস ধ্বংস না করে শুধু ওষুধ ছিটানো বা হঠাৎ অভিযান দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পুরো বছরজুড়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, এডিস মশা এখন আর মৌসুমি আতঙ্ক নয়। এটি শহরের স্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। সংক্রমণ, মৃত্যু, ওয়ার্ডভিত্তিক ঝুঁকি সবকিছুই বাড়ছে প্রতি বছর। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া একই থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জরিপের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত আইইডিসিআরের কিউরেটর ওমর কাইয়ুম বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন প্রয়োজন স্থানীয় সংস্থাগুলোর সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ। সুপারিশ অনুযায়ী কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়, সে দিকেই নজর দিতে হবে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইইডিসিআর যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয় করে কাজ চলছে। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ